পর্যাপ্ত মজুত থাকলেও রমজানে খাদ্যপণ্যের দাম কমার আশা কম

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: বাংলাদেশের ভোক্তাদের জন্য কোনো স্বস্তির চিহ্ন এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। বরং ব্যবসায়ীরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, লোহিত সাগর সংকটের কারণে ফ্রেইট খরচ বাড়ার ফলে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়তে পারে। অথচ বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে। রমজানকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা চিনি, খেজুর, ভোজ্য তেল, ডাল, ছোলা ও পেঁয়াজেরও ভালো মজুত করেছেন।

কিন্তু স্থানীয় ভোক্তাদের জন্য কোনো সুখবর নেই। ডলার সংকট এবং লোহিত সাগরের দ্বন্দ্বের কারণে আমদানি ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে দাবি করে ব্যবসায়ীরা বলছেন, খাদ্যপণ্যের দাম কমার সম্ভাবনা নেই।

তবে এ পরিস্থিতি বিশ্ববাজারের সম্পূর্ণ বিপরীত। বৈশ্বিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম গত তিন বছরের সর্বনিম্নে নেমে এসেছে।

সিরিয়াল এবং মাংসের পতনের কারণে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বিশ্ব মূল্যসূচক জানুয়ারিতে প্রায় তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে। জানুয়ারিতে এ সূচকের মান গত ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর থেকে সর্বনিম্ন ছিল।

কিন্তু বাংলাদেশের ভোক্তাদের জন্য কোনো স্বস্তির চিহ্ন এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। বরং ব্যবসায়ীরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, লোহিত সাগর সংকটের কারণে ফ্রেইট খরচ বাড়ার ফলে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়তে পারে।

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ বাজারের পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, রোজার মাস শুরু হওয়ার তিন থেকে চার মাস আগে রমজানের ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হয়। তবে কোনো সংকটের কারণে চাহিদার তুলনায় আমদানির পরিমাণ কমে গেলে রাতারাতি দাম বেড়ে যেতে পারে।

খাতুনগঞ্জের মেসার্স এ জামান ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী নুরুল আলম বলেন, ‘এবার ছোট-বড় আমদানিকারকেরা মিলে পর্যাপ্ত ভোগ্যপণ্য আমদানি করেছেন। রমজানের বাজারে কোনো সংকট হওয়ার সম্ভবনা নেই। তবে পণ্যের আমদানি খরচ আগের তুলনায় বেশি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ট্যারিফ কমিশনের যেভাবে দর নির্ধারণ করবে, আমরা সেভাবে বিক্রি করব।’

এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, রমজানের আর মাত্র দেড় মাসেরও কম সময় বাকি থাকলেও এ বছর বাজারে এসব পণ্যের বুকিং ও বিক্রি তুলনামূলকভাবে কম।

আমদানিকারকরা বলছেন, রমজানে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে চিনি, ভোজ্য তেল, ছোলা ও পেঁয়াজ পর্যাপ্ত পরিমাণে আমদানি করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের তথ্যমতে, গত বছরের ১ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রায় এক লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন চিনি আমদানি হয়েছে। যা আগের মৌসুমে একই সময়ে ছিল প্রায় ৮০ হাজার মেট্রিক টন।

একইভাবে গত সাড়ে তিন মাসে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে সাত লাখ ৪৭ হাজার মেট্রিক টন, যা আগের মৌসুমে ছিল ছয় লাখ ৫৯ হাজার মেট্রিক টন। পাশাপাশি এবার ছোলা আমদানি হয়েছে ৪৯ হাজার মেট্রিক টন। গত মৌসুমে এটি ছিল ২৪ হাজার ৪৮৬ মেট্রিক টন। ছোলার বার্ষিক চাহিদার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই রমজানের সময় লাগে।

গত সাড়ে তিন মাসে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে এক লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন যা গত মৌসুমের একই সময়ের এক লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টনকে ছাড়িয়ে গেছে।

অপরদিকে, এ সাড়ে তিন মাসে খেজুরের আমদানির পরিমাণ ছিল ১০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি। যা গত মৌসুমের একই সময়ে ছিল ২৫ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ এবার খেজুর আমদানির পরিমাণ ৫৯ দশমিক ২৯ শতাংশ কম। খেজুরের বার্ষিক চাহিদার প্রায় অর্ধেক সাধারণত রমজানে বিক্রি হয়।

এছাড়া, এবার একই সময়ের মধ্যে ডাল আমদানি করা হয়েছে এক লাখ ৭৩ হাজার মেট্রিক টন, যা গত বছর আমদানি করা এক লাখ ৯০ হাজার মেট্রিক টনের তুলনায় ৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপ-কমিশনার ব্যারিস্টার মো. বদরুজ্জামান মুন্সী বলেন, রমজানে চাহিদা থাকা ভোগ্যপণ্যগুলো গত বছরের চেয়ে অনেক বেশি আমদানি হয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু পণ্য খালাস হয়েছে। আরও পণ্য খালাসের অপেক্ষায় আছে। এছাড়া আমদানিকৃত আরও পণ্য বন্দরের পথে রয়েছে। এবার কোনো সংকট হওয়ার সম্ভবনা নেই।

খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের মতে, বর্তমানে পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি চিনি ১৩৪ টাকা, ভালো মানের ছোলা প্রতি কেজি ৯১ টাকা, মাঝারি মানের ছোলা প্রতি কেজি ৮৩–৮৮ টাকা এবং নিম্নমানের ছোলা প্রতি কেজি ৭৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া পাইকারি ভোজ্য তেল লিটারপ্রতি ১৭৬ টাকা এবং পাম তেল ১৩০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।

এছাড়া, প্রতি কেজি মুগডাল ১৬০ টাকা, মটর ডাল ৭০ টাকা, মোটা মসুর (অস্ট্রেলিয়ান) ১০২ টাকা এবং চিকন মসুর (দেশি ও ভারতীয়) ১৩৪–১৩৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে পাবনার মুড়িকাঁটা পেঁয়াজ প্রতিকেজি ৮০–৮৫ টাকা, মেহেরপুরের পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৮৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে পাইকারিতে।

দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, গত বছরের তুলনায় ভোজ্য তেলের দাম কিছুটা কম হলেও চিনি ও ডালের দাম বাড়ছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে গত এক বছরে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া এখন মূল উদ্বেগের বিষয়।

আমাদের এখন আমদানিতে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়, ঋণপত্র খুলতে ১২০–১২৫ শতাংশ নগদ মার্জিন দরকার হয়। ফ্রেইট চার্জ বাড়ার কারণে কারণে লোহিত সাগরের সংকট পণ্যের দামকে আরও প্রভাবিত করার ঝুঁকি তৈরি করছে, তিনি বলেন।

লোহিত সাগর সংকটের প্রভাব
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স এসোসিয়েশনের মতে, দেশের মোট আমদানির প্রায় ৮ শতাংশ এই রুট দিয়ে পরিবহন করা হয়।

মেঘনা গ্রুপের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, সুয়েজ খাল ও লোহিত সাগর রুটে ফ্রেইট খরচ ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ফলে অন্যান্য রুটেও জাহাজ ভাড়া ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভোগ্যপণ্য আমদানিতে এখন বাল্ক কার্গো জাহাজের জন্য ১০–১৫ শতাংশ বেশি ভাড়া দিতে হয়। আমরা লোকসানের মুখে পড়ছি এবং ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তবে বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স এসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা বলছেন, যদিও লোহিত সাগর সংকটের কারণে জাহাজের ফ্রেইট চার্জ বেড়েছে, তবে সরবরাহ চেইনের এই বিঘ্ন রমজানের প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে কোনো প্রভাব ফেলেনি।

এসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল ইসলাম সুজন বলেন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ ভোগ্যপণ্য চীনসহ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলো থেকে আমদানি করা হয়।

কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সংকটের মূল বিষয়টি মোকাবিলায় তাদের প্রচেষ্টা অকার্যকর বলে মনে হচ্ছে।

তিনি উল্লেখ করেন, কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রাথমিক ভাবে অনেক পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু খুব কম পণ্যের দামই পরে কমেছে। পরবর্তীকালে ডলার সংকটের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ানোর ন্যায্যতা দেওয়া হয়। এখন দাম আরও বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীরা লোহিত সাগরের সংকটকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছেন।

আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও আমাদের দেশে কেন অনেক পণ্যের দাম কমেনি বলে প্রশ্ন তোলেন তিনি। টিবিএস।